অধিকার আদায়ে বীরদর্পে গর্জে ওঠা আর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া বাঙ্গালি জাতির পুরানো ইতিহাস। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও যুদ্ধে মেতে উঠেছিলেন বাঙালিরা। নেত্রকোণার স্বাধীনচেতা জনগোষ্ঠী ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের সারাংশ শুনেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে যেতে হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধের জন্য নেত্রকোণাবাসীর প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় ব্যয় হয়নি। ৭ মার্চ এর পর থেকেই নেত্রকোণার প্রত্যেক থানা শহরগুলোতে যুদ্ধে যাবার জন্য যুব সমাজ উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন থানা পর্যায়ে গ্রামগুলো থেকে বহু মানুষ সশস্ত্র মিছিল করে আসতে থাকেন। নেত্রকোণা শহরসহ থানা শহরগুলোর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান মানুষগুলোও নীতি নির্ধারণের কাজ শুরু করে দেন।
৩ মার্চ নেত্রকোণা মহুকুমা ছাত্রলীগের উদ্যোগে মিছিল হয়। এর পর থেকেই প্রতিদিন নেত্রকোণা শহরে মিছিল আর মিছিল হতে থাকে। ২৩ মার্চ নেত্রকোণা শহরের মোক্তারপাড়া মাঠে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ভষ্ম করা হয় এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয়। ২৭ মার্চ নেত্রকোণা আওয়ামী লীগ অফিসে নেত্রকোণা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সেদিন থেকে শহরের অবস্থা আরো ভয় ও শঙ্কায় নিমজ্জিত হতে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে ওঠে চঞ্চল। নেত্রকোণা শহরের বর্তমান জনতা হোটেল, সমতা বেকারী, আওয়ামীলীগ অফিসের পাশে তৎকালীন চৌধুরীর স্টল, স্টেশন রোডে নদীর উপর তৎকালীন জলযোগ রেঁস্তোরা ও কলেজ ক্যান্টিনের রাজনৈতিক মহুকুমা পুলিশ প্রশাসনকে স্থানীয় যুবকরা আটক করে ফেলে। সে দিনই পুলিশ প্রশাসনের অস্ত্রাগার থেকে ৩’শ রাইফেল সংগ্রহ করা হয়। নেত্রকোণা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়টি অস্থায়ী যুদ্ধশিবির হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। সেখানেই শুরু হয় অস্থায়ীভাবে মুক্তিযোদ্ধদের প্রশিক্ষণ। অপর দিকে মার্চ মাসের শেষার্ধে জারিয়া হাই স্কুল মাঠে মনির উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বেও একটি প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হচ্ছিল। দূর্গাপুর সীমান্ত থেকে ইপিআর এর সুবেদার আজিজুল হক ৫টি রাইফেল নিয়ে এসে প্রায় ২’শ যুবককে জারিয়ার প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ প্রদান করছিলেন। এপ্রিল মাসের প্রথম পক্ষকাল পর্যন্ত সে প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হয়েছিল। নেত্রকোণার প্রায় অধিকাংশ থানা সদরেই স্বাধীনতাকামী মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলে। গড়ে তোলে প্রশিক্ষণ শিবির। এতে মহকুমা শহরসহ থানা পর্যায় পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মনোবল বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষও পাক হানাদারদের প্রতিরোধকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থায় আগ্রহী হয়ে উঠে।
২৩ এপ্রিল সকাল ৯ টায় নেত্রকোণা শহরের উপর পাকিস্তানীদের দু’টি সুরমা রং এর যুদ্ধবিমান গুলি বর্ষণ করে চলে যায়। এতে নেত্রকোণার সাধারণ মানুষ সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে। প্রশিক্ষণ শিবিবের ইপিআর সদস্যরা বিষয়টি অনুধাবন করে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র ছাড়াই রাইফেল দিয়ে বিমানের দিকে গুলি ছুড়ে সাধারণ মানুষদের ভীতিহ্রাস করার চেষ্টা করেন। এতে তেমন কোনো ফল আসেনি। দুপুর নাগাদ নেত্রকোণা শহর জনমানব শূন্য হয়ে যায়। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও নেত্রকোণা শহরকে নিরাপদ মনে করেননি। এই দিনই তারা নেত্রকোণা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিবির পূর্বধলায় স্থানান্তর করেন। পূর্বধলাকে তারা নেত্রকোণা শহর থেকে অনেক নিরাপদ মনে করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধেও অর্থ সংগ্রহ করতে ওই রাতে নেত্রকোণার ন্যাশনাল ব্যাংকের Volt ভেঙ্গে টাকা পয়সা ও সোনা সংগ্রহ করেন। খাদ্য সংগ্রহ করতে জারিয়া সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে চাল, চিনিসহ প্রচুর খাদ্য সামগ্রী সীমান্তেও ওপারে বাঘমারায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। নেত্রকোণা অস্ত্রাগার থেকে সংগৃহিত অস্ত্রসহ বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকাধীন অস্ত্র নিয়ে ভারতের বাঘমারা, মহাদেও, রংরা ও মহেষখলার গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। এছাড়া মদন থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে আটক করে থানার অস্ত্রগুলো নিয়ে মহেশখলা ক্যাম্পকে আরো শক্তিশালী করে তোলেন।
সীমান্তের ওপারে যাবার পূর্বেই শ্যামগঞ্জ, চল্লিশা, পূর্বধলা, রামপুর, কেন্দুয়া প্রভৃতি স্থানে স্থানীয়ভাবে ছাত্রলীগ কর্মীরা পাক সেনাদের গতিরোধ করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। স্থানীয় মানুষদের সংগঠিত করে নেতৃত্ব দেন আব্দুল খালেক এমসি, আওয়ামীলীগ সম্পাদক এডভোকেট ফজলুর রহমান, আব্দুল মজিদ তারা মিয়া, আববাস খাঁ, খালেকদাদ চৌধুরী, এডভোকেট ফজলুল কাদের, মৌলানা ফজলুর রহমান খান, এন আই খান, নুরু মিয়া, পূর্বধলার নজমূল হুদা, সাদির উদ্দিন আহম্মেদ, কাজী ফজলুর রহমান, ইউনুছ আলী মন্ডল, জারিয়ার মনির উদ্দিন সরকার, আমানত খাঁ, মারফত খাঁ, সৈয়দ নূর উদ্দিন, মোহনগঞ্জের ডা. আখলাকুল ইসলাম, কলমাকান্দার আব্দুল জববার আনসারী, ডাঃ মোসলেম উদ্দিন, দূর্গাপুরের রফিক উদ্দিন ফরাজী, জালাল উদ্দিন তালুকদার, বারহাট্টার নূরুল হোসেন খন্দকার, খালিয়াজুরীর সিদ্দিকুর রহমান, কেন্দুয়ার হাদিস উদ্দিন চৌধুরী, এম. জুবেদ আলী, আটপাড়ার সেকান্দর নূরী, মদনের খন্দকার কবির উদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম ভূঞা, ডাঃ রইছ উদ্দিন, ছাবেদ আলী প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। এ সময় ন্যাপ নেতা আজিজুল ইসলাম খান, ওয়াজেদ আলী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সুকুমার ভাওয়াল, মৃনাল কান্তি বিশ্বাস, আবদুল মোত্তালিব মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের জন্য সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছিল। ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে বেশ তৎপরতা লক্ষ্যণীয়। সে সময় গোলাম এরশাদুর রহমান, আশরাফ উদ্দিন খান, শামছুজ্জোহা, সাফায়াৎ আহমেদ, বাদল মজুমদার, আবু সিদ্দিক আহমেদ, হায়দার জাহান চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা, মেহের আলী, গুলজার আহমেদ, আনিসুর রহমান, আবু আক্কাছ আহমেদ, মোহনগঞ্জের হীরা, পূর্বধলার আব্দুল কুদ্দুছ তাং, আবুল হাসিম, মাহফুজুল হক, মাফিজ উদ্দিন, আব্দুল মান্নান খান, আব্দুল আউয়াল আকন্দ, এখলাছ উদ্দিন, আব্দুল হেলিম, নাজিম উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন প্রমুখ ছাত্র ও যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য রাতদিন শ্রম দিয়েছিলেন।
২৮ এপ্রিল পর্যন্ত নেত্রকোণা ছিল পাকহানাদার মুক্ত। পরিবেশ ছিল থমথমে প্রতিটি মানুষ ছিল শঙ্কিত। ২৯ এপ্রিল (১৫ বৈশাখ ১৩৭৮) সর্বপ্রথম নেত্রকোণা শহরে পাকহানাদার বাহিনীর একটি দল প্রবেশ করে। একই দিনে এরা পূর্বধলায়, পরদিন দূর্গাপুর সদরে প্রবেশ করেছিল। পাশাপাশি সময়ের মধ্যেই নেত্রকোণা জেলার (তৎকালীন মহুকুমা) খালিয়াজুরী ব্যতীত সকল থানা সদরে তাদের প্রবেশ কার্য শেষ করে ফেলে। থানা সদরগুলোতে তাদের স্থায়ীক্যাম্প স্থাপন ও জারিয়া, বিরিশিরি, ঠাকুরাকোণা, শ্যামগঞ্জ ও বিজয়পুরসহ বিশেষ স্থানগুলোতে তাদের অস্থায়ী ক্যাম্প করে। সে সকল স্থানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে সেতু নির্মাণসহ বিভিন্ন সেতুতে প্রহরা বসিয়ে দেয়। প্রত্যেক সেতুর পাশেই বাংকার নির্মাণ করে তাদের অবস্থান দৃঢ় করে।
এ এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর ব্রিগেড কমান্ডের দপ্তর ছিল ময়মনসিংহে। অধিনায়ক ছিল ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদির খান। নেত্রকোণা অঞ্চল সেই ব্রিগেডের ৭১ উইং রেঞ্জার্স ফোর্সের অধীনে ছিল। ২৯ এপ্রিল নেত্রকোণা শহরে পাকবাহিনী প্রবেশ করে পিটিআই-এ তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। আখড়ার মোড়ে সাহা স্টুডিওতে মিলিশিয়া ক্যাম্প, জেলা রাজাকার, আল-বদর, আল-মুজাহিদের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। মাছবাজারের এডভোকেট শ্রীশচন্দ্র সরকারের বাসায় নেজামে ইসলামে অফিস স্থাপন করে। সর্বমোহন বণিকের দোতলা বাড়িকে পাক হানাদাররা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করে। এ টর্চার সেলে নেত্রকোণার নিরীহ জনসাধারণকে ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। সেখানে নির্যাতন শেষে থানার পাশে নদীর পাড়, চন্দ্রনাথ স্কুলের পাশে নদীর তীরে অথবা নেত্রকোণা-পূর্বধলা রাস্তায় ত্রিমোহনী ব্রিজে এনে গুলি করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হতো।
ইতোমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতির জন্য সীমান্তবর্তী ভারতীয় অংশে মুক্তিযোদ্ধাগণ তৈরি করে ইয়ূথ ক্যাম্প। সমর প্রস্তুতির ক্যাম্প। মহেষখলা, মহাদেও, রংড়া ও বাঘমারা নামক স্থানে সাংগঠনিক প্রাথমিক পর্যায়ের প্রস্তুতি চলে। মহেষখলা ক্যাম্পের নেতৃত্ব দেন ধর্মপাশার আব্দুল হেকিম চৌধুরী এমপি। মোহনগঞ্জের ডা. আখলাকুল ইসলাম এমপি। নেত্রকোণার এডভোকেট ফজলুল কাদের, সাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী, ডা. জগদীশ দত্ত প্রমুখ। মহাদেও ক্যাম্পের নেতৃত্বে দেন কলমাকান্দার আব্দুল জববার আনসারী, আটপাড়ার হাবিবুর রহমান খানসহ অনেকে। রংরা ক্যাম্পের দায়িত্বপালন করেন নেত্রকোণার আববাছ আলী খান এমপি, গোলাম মোস্তফা, সুবেদার আজিজুল ইসলাম খান প্রমুখ। বাঘমারা ক্যাম্পের দায়িত্বপালন করেন নেত্রকোণার এন আই খান, পূর্বধলার নজমূল হুদা এমপি, দূর্গাপুরের রফিক উদ্দিন ফরায়জী প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। ওই ক্যাম্পগুলোতে ভর্তিকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ নেত্রকোণার যুবক ছিল।
১১নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন (আগষ্ট-নভেম্বর) মেজর আবু তাহের, (নভেম্বর-ডিসেম্বর) স্কো. লিডার এম. হামিদ উল্লাহ। সেক্টরটি মোট ৮টি সাব সেক্টরে বিভাজন করা হয়েছিল। বর্তমান নেত্রকোণার মুক্তিযোদ্ধারা বাঘমারা থেকে মহেষখলা পর্যন্ত স্থানে বাঘমারা, রংরা, মহষেখলা সাব সেক্টর কমান্ডের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন। এর মধ্যে নজমূল হক তারা, তোফাজ্জল হোসেন চুন্নু, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিরা ছিলেন সাব সেক্টরের দায়িত্বে। ওইসব সেক্টরগুলোর লোকবলকে প্রশিক্ষিত করে জুন মাসের মাঝামাঝি সময় অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। সে সময় দূর্গাপুরের টাংগাটি, ফারাংপাড়াসহ সীমান্তবর্তী পাকবাহিনীর অবস্থানের উপর খন্ড খন্ড আক্রমণ ক্রমাগতভাবেই চলছিল। কিন্তু সে সকল আক্রমণের তেমন তীব্রতা লক্ষ্য করা যায় না। তবে জুন মাসের শেষ প্রান্তে অর্থাৎ ২৮ জুন মুক্তিযোদ্ধারা একটি তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে। সে দিন দূর্গাপুরের বিজয়পুর পাকসেনাদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের হঠাৎ আক্রমণে পাক সেনারা নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। সে যুদ্ধের স্থায়ীত্বকাল ছিল মাত্র কয়েক ঘন্টা। ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ চন্দ্র বিশ্বাস শহীদ হয়েছিলেন।
৭ জুলাই, সকাল আনুমানিক ১০টা। নেত্রকোণার সদর থানার বাঁশাটি গ্রাম। গোয়েন্দা সূত্রের খবরের প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থান নেয়। ওপার থেকে নৌকাযোগে পাকহানাদাররা তাদের সহযোগীদের নিয়ে এগোচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ। অস্ত্রের অব্যর্থ গুলিতে পাকহানাদারদের নৌকাটি ঝাঝরা হয়ে পানিতে তলিয়ে যায়। শত্রুপক্ষের বেশ ক’জন পাকহানাদার নিহত হয়। বাকীরা সাঁতরিয়ে ওপারে ওঠে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এদের পিছু ধাওয়া করে ৭(সাত) জনকে ধরে ফেলে এ ৭ জনের মধ্যে পাক হানাদারদের সহযোগী বাঙালি ছিল ক’জন। এদের মধ্যে তৎকালীন নেত্রকোণা সদর থানার দারোগা আব্দুর রশিদ, আনসার এ্যাডজোটেন্ট লাল মিয়া ও আব্দুল মালেক অন্যতম। এ সাত জনকেই মুক্তিযোদ্ধারা ভারতের তুরা ক্যাম্পে ক্যাপ্টন চৌহানের কাছে বন্দি অবস্থায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।
এ সংবাদে নেত্রকোণা থেকে পাকহানাদারদের একটি দল দুপুর দু’টার দিকে বড়ওয়ারী ফেরীঘাটে হাজির হয়। ৩টার সময় এরা নদী পাড়ি দিয়ে এ পাড়ে ওঠে। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গুলির স্বল্পতা ছিল। সে কারণে মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিকের পরামর্শে সকল মুক্তিযোদ্ধারা আত্মরক্ষামূলক আক্রমণের কৌশল অবলম্বন করে। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের অপেক্ষাকৃত কমগুলি বর্ষণে শুধু সময় ক্ষেপণ করে চলে। পাকহানাদাররা বেলা ৩টা থেকে ১ ঘন্টায় মাত্র ১ মাইল এগোতে পেরেছিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় পাকহানাদাররা ভয়ে পিছনে সরে সন্ধ্যার পূর্বেই নেত্রকোণায় ফিরে আসে।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর হয় বিরিশিরি থেকে কলমাকান্দায় পাকসেনাদের ক্যাম্পে রসদ যাবে ২৬ জুলাই সকাল ৮টার দিকে। এ সংবাদে বিএসএফ ক্যাম্পের অধিনায়ক বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। পরিকল্পনা হয় দূর্গাপুর-কলমাকান্দা নদীপথের নাজিরপুর বাজারের কাজেই পাকহানাদারদের আক্রমণ করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কমান্ডার নাজমুল হক তারার নেতৃত্বে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা নাজিরপুর পৌঁছে যায় ২৫ জুলাই সন্ধ্যায়। ৩টি পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে নাজিরপুর বাজারের সবক’টি প্রবেশ পথ আগলে এ্যামবুস করেন মুক্তিযোদ্ধারা। অপেক্ষা চলছিল কখন আসবে পাকহানাদাররা। ২৬ জুলাই সকাল ৯টা অতিক্রান্ত হলো পাকহানাদারদের হদিস নেই। মুক্তিযোদ্ধারা একে একে তাদের এ্যাম্বুস তুলে নেয়ার সময় হঠাৎ হয়ে যায় হানাদার বাহিনীর মুখোমুখী অবস্থান। গুলি, পাল্টা-গুলি উভয়পক্ষের তুমুল যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান পরিবর্তন ও অতর্কিত যুদ্ধে তারা অনেকাংশে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। এরপরেও তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকহানাদাররা এক পর্যায়ে ক্রলিং করে সন্তপর্ণে মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স এলাকায় ঢুকে পড়ে।
দুপুর দিকে পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর এলএমজি পজিসন নির্দিষ্ট করে জামাল এর অবস্থানের উপর ফায়ার শুরু করে। পাকহানাদারদের গুলিতে ঘটনাস্থলে জামাল উদ্দিন শহীদ হন। বিকেল দিকে পাকবাহিনীর আক্রমণ আরো তীব্র আকার ধারণ করে। গুলির আঘাতে কমান্ডার নজমুল হক তারার কণ্ঠনালী ছিড়ে যায়। এতে যুদ্ধের গতি পাল্টে যায়। পাক হানাদাররা সশস্ত্র অবস্থায় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বন্দি করে বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে অন্যরা আত্মরক্ষা করে ক্যাম্পে ফিরে আসে। সে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন জামাল উদ্দিন, ডা. আব্দুল আজিজ, ফজলুল হক, ইয়ার মামুদ, ভবতোষ চন্দ্র দাস, নূরুজ্জামান, দ্বীজেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস ও জনৈক কিশোর কালা মিয়া। ২৭ জুলাই সন্ধ্যায় লেঙ্গুরার ফুলবাড়ি নামক স্থানে ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে ১১৭২ নম্বর পিলারের কাছে তাদের সমাহিত ও দাহ করা হয়। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ। দূর্গাপুরের বিজয়পুর সীমান্ত ফাঁড়ির কাছেই আড়াপাড়ায় ছিল পাক রেঞ্জার্স এবং রাজাকার বাহিনীর নিয়মিত অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধাদল আড়াপাড়া ক্যাম্পে আক্রমণ করে। সে সময় পাক রেঞ্জার্স ও রাজাকারদের অবস্থান ছিল বাংকারের অভ্যন্তরে। ফলে এদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে এ আক্রমণ ছিল হানাদারদের শক্তি পরীক্ষা।
জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পাক হানাদারদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিতে হবে। তারই অংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিক আহমেদের দল ঠাকুরাকোণা রেল ব্রিজ ধ্বংসের জন্য ১৩ জুলাই ঠাকুরাকোণায় যায়। হাবিব, আবু আক্কাছ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন মধ্যরাতে ডিনামাইট বিষ্ফোরণ করে ঠাকুরাকোণা রেল ব্রিজটি ধ্বংস করে দেয়। এতে নেত্রকোণার সঙ্গে মোহনগঞ্জের যোগাযোগ সাময়িক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
১১ আগষ্ট পূর্বরাতে প্রবল বর্ষণের মধ্যে পূর্বধলা থেকে এক কোম্পানী পাক সৈন্য কিছু সংখ্যক রাজাকার কে সঙ্গে নিয়ে তৎকালনি পূর্বধলা থানাধীন গোয়াতলা বাজারে রওনা দেয়। ১১ আগষ্ট প্রায় ১০ টার দিকে কংসনদীর কাছাকাটি পৌঁছতেই মুক্তিযোদ্ধারা গোয়াতলা বাজারে প্রবেশ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুঠপাট করে। সে দিন বিকেলেই পাকসৈন্যরা পূর্বধলায় ফিরে আসে।১৩ আগষ্ট রাতে মুক্তিযোদ্ধারা কেন্দুয়া থানা আক্রমণ করে। সে যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর গুলিতে ৬ জন পাকসৈন্য নিহত হয়েছিল এবং মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদারদের ১৫টি রাইফেল (এর মধ্যে ২টি চায়নিজ) ১৭টি পাকিস্তানী সেকান্দার বন্দুকসহ বেশ কিছু গোলা বারুদ দখল করে নেয়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা কেন্দুয়া থানা কার্যালয়ের কাগজপত্র আগুন ধরিয়ে ভষ্ম করে দিয়ে আসে।
১৪ আগষ্ট বিরিশিরি-বিজয়পুর রাস্তায় পাকসৈন্যদের এক টহল পার্টির উপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। অতর্কিত আক্রমণে দু’পাক সেনা নিহত হয়। একই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বারহাট্টা থানা সদর আক্রমণ করে করে এবং ১২৫টি যুদ্ধাস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ঐ যুদ্ধে আটপাড়া থানার শালকী মাটি কাটা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হারেছ শহীদ হন।
১৪ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা দুর্গাপুরের ফারাংপাড়া পাকসেনাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। নির্ধারিত সময় শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। সে যুদ্ধের হতাহতের খবর পাকসেনারা বেতারে আদান প্রদান করছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের বেতারে সে সংবাদ ধরা পড়লে তারা দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে পড়ে। সে দিনের যুদ্ধে ১৪ জন পাক সৈন্যের হিনতের সংবাদ বেতারের আদান প্রদান হচ্ছিল। উল্লেখ করা প্রয়োজন ফারাংপাড়া ক্যাম্পটি ২ আগষ্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে প্রতি রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে চলছিল।
১৮ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হারুন-অর-রশীদ ও ননী গোপালের নেতৃত্বে ১৮ জনের ২টি দল পূর্বধলার শ্যামগঞ্জের পশ্চিমে এক রাস্তার পাশে রাজাকার হত্যা করে। ১৯ আগষ্ট নাজমুল হক তারার দল আটপাড়া থানা আক্রমণ করে। সে আক্রমণে আটপাড়া থানার তৎকালীন ওসি মোজাম্মেল হকসহ কয়েকজন নিহত হয়। বাকীরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আকস্মিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সে আক্রমণে মুক্তিকামী মানুষের সাহস সঞ্চার হয়েছিল। সে দিন মুক্তিযোদ্ধারা ১৭টি রাইফেল (মতান্তরে ২২টি) হস্তগত করে নিয়েছিলেন। থানা কার্যালয়ের কাগজপত্রে অগ্নিসংযোগ, পোষ্ট অফিস তছনছ ও স্থানীয়ভাবে যোগাযোগের মাধ্যম টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ৪টি টেলিফোন সেট নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধাদের চোরাগুপ্তা আক্রমণে বেশ ক’জন পাক সেনা ও রাজাকার নিহত হয়েছিল। সেই অঞ্চলে ২০ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা দূর্গাপুরের বিজয়পুরে পাক হানাদারের উপর আক্রমণ চালায়। সে আক্রমণে পাক হানাদারদের ৫টি বাংকার ধ্বংস হয়। ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। সে যুদ্ধে মোহনগঞ্জ উপজেলার বড়ান্তর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা একদিল হোসেন শহীদ হয়েছিলেন।
আগষ্ট মাসটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সুফল বয়ে আনার মাস। সে মাসের প্রতিটি যুদ্ধেই মুক্তিযোদ্ধারা সফল হয়েছিলেন। সে মাসে গেরিলা কায়দায় সফল যুদ্ধ ছিল বারহাট্টা থানা দখল। তারিখ ১৪ আগষ্ট (আনুমানিক)। মুক্তিযোদ্ধারা থানার জমাদার তসলিম উদ্দিনের পরামর্শে বারহাট্টা থানা দখলের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকাদের পেশাক পরে থানা দখলে এগিয়ে যায়। ডিউটি পরিবর্তনের সময় অর্থাৎ ১২ টা ১ মিনিটে রাজাকাদের পোশাক পরে মুক্তিযোদ্ধারা থানার প্রথম বাংকারে হাজির হয়। রাজাকারদের বুঝে ওঠার আগেই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্রসহ ধরে পেলে। সেই রাজাকারের দ্বারা বাকীদের আত্মসমর্থনের আহবান জানান। বিনা বাধায় সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা বারহাট্টা থানা দখল করে ১২৫টি অস্ত্র হস্তগত করেছিলেন। সেদিন থানার ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুর রউফ ও দালাল মোকশেদ আলীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো রাজাকারকে তাদের সহযোগিতার মনোভাবের জন্য হত্যা করা হয়নি।
২৮ আগষ্ট মদন থানা সদরের যুদ্ধ ছিল অত্রাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য রণক্ষেত্র। মদন থানা সদর ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা মদন দখল করে সমগ্র ভাটি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছিলেন । সে অবস্থায় পাক হানাদাররা মদন আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তারা কেন্দুয়া থেকে গুগবাজার, কাইটাল পথে মদন অভিমেুখে যাত্রা করেছিল। কাইটাল হয়ে বাহেরাখলা নদী অতিক্রম করার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাক হানদারদের আগমণ সংবাদ পৌছে যায়। পাক হানাদাররা ওই দিন বিকেল আনুমানিক ৪ টায় জাহাঙ্গীরপুর হাই স্কুল মাঠে অবস্থান নেন। জাহাঙ্গীরপুর ও মদন থানা সদরের মাঝখানে মগড়া নদী। মুক্তিযোদ্ধারা ওঁৎপেতে বসেছিল কখন পাক সৈন্যরা নদী পাড়ি দেবে। বিকেল ৪টার পরেই পাক সৈন্যরা নৌকাযোগে মগড়া পাড়ি দেবার জন্য চেষ্টা করে। নৌকা নদীর মাঝখানে আসতেই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পড়ে। এলএমজি-র ব্রাশ ফায়ারে নৌকায় আরোহী পাক হানাদাররা পানিতে তলিয়ে যায়। কয়েকজন আতমরক্ষা করে ফিরে যায়। সে সময় ৫ জন মুক্তিযোদ্ধ একটি দল জাহাঙ্গীরপুর হাইস্কুল মাঠে অবস্থানরত পাক সৈন্যদের কয়েক’শ গজ দূরে অবস্থান গ্রহণ করেন। নদী থেকে ফিরে আসা পাকবাহিনীরা জাহাঙ্গীরপুর হাই স্কুল মাঠ অবস্থানরত পাকসেনাদের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার পরই মুক্তিযোদ্ধোদের দলটি দ্বিতীয় আক্রমণ রচনা করে। সে সময় পাকসৈন্যদের বেশ ক’জন নিহত হয়েছিল। ৫ সদস্যের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষুদ্র দলটি নদী অতিক্রম করে মদন থানা সদরে মূল প্লাটুনের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। মগড়া নদীকে মাঝখানে রেখে সারা রাত যুদ্ধ চলে।
উভয়পক্ষের অবিরাম গোলাবর্ষণে সমগ্র অঞ্চলটি রণাঙ্গণে পরিণত হয়ে পড়েছিল। পরদিন অর্থাৎ ২৯ আগষ্ট মুক্তিযোদ্ধদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সকাল ৮টার দিকে পাক সৈন্যরা মগড়া নদীর পাড়ি দিয়ে থানা সদরে প্রবেশের চেষ্টা করে। নৌকাযোগে পাক হানাদাররা পুনরায় মালনীপাড়া দিয়ে যাবার সময় নদীর মাঝপথে থাকতেই মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে। এলএমজি’র আক্রমণে পাকবিাহিনীর নৌকা পানিতে ডুবে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে ও সাঁতার না জানা অনেক পাকসৈন্য নিহত হয়। এতে পাক হানাদাররা মনোবল হারিয়ে ফেলে। সে সংবাদে পাক হানাদারদের সহযোগিতায় বেলা ১ টার দিকে একটি হেলিকপ্টার আসে। হেলিকপ্টার থেকে পাক হানাদাররা অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এতে আহত হয় আইয়ুব আলী ও জাহেদ। হেলিকপ্টার থেকে করা গুলিতে মারাত্মক আহত হয় প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল কুদ্দুছ। অত্যধিক রক্তক্ষরণে রাত সাড়ে ৮ টায় শহীদ হন প্লাটুন কমান্ডার, হাঁসকুলি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কুদ্দুছ। সে অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চদাপসরণ ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। পাকহানাদাররা সাময়িকভাবে সে সময় মদন থানা সদর দখল করে নেয়।
২১ সেপ্টেম্বর মোহনগঞ্জের অদূরে বারহাট্টা থানাধীন আলোকদিয়া গ্রামে ১ জন পাকসেনাকে গ্রামবাসী ধরে ফেলে। আব্দুর রহমান নামক সে পাকসেনা আলোকদিয়া গ্রামে ডাব পানের জন্য আসলে গ্রামবাসী তাকে জীবন্ত ধরে মহেষখলা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে প্রেরণ করেছিল। এতে পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। পরদিন অর্থাৎ ২২ সেপ্টেম্বর পাক সেনারা আলোকদিয়া গ্রামটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
২২ সেপ্টেম্বর কেন্দুয়া-মদন রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুব আলম এর কোম্পানী এ্যামবুশ পেতে থাকে। সেই পথে পাক আর্মিরা যাতায়াত করতো। সেদিন কাইটাল ও বাড়রী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যামবুশের ভেতরে পড়ে ৮১ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাক হানাদাররা পূর্বেই মদন দখল করে নিলেও তারা মূলত মুক্তিবাহিনীর দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল। কাইটাল ও বাড়রীতে পাক হানাদারদের আক্রমণের সময় মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক হীরা আহত হয়েছিলেন।
২৩ সেপ্টেম্বর দূর্গাপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় পাক সেনাদের নিয়মিত টহল দলের উপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। উভয়পক্ষ প্রায় এক ঘন্টা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ২৪ সেপ্টেম্বর রামা মাদ্রাসা, চরবাট্টা ও কেন্দুয়ার এক রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা এ্যামবুশ পেতে ১৬ জন পাক আর্মি ও ৯ জন রাজাকারকে হত্যা করে।
নেত্রকোণা-মোহনগঞ্জ রাস্তার ঠাকুরাকোণা রেল সেতুটি ভাঙ্গার পর থেকেই ত্রিমোহনী সেতুটি ভাঙ্গার পরিকল্পনা ছিল। ২৫ সেপ্টেম্বর পূর্বধলা-নেত্রকোণা রাস্তার ত্রিমোহনী সেতুটি মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিক আহমেদের নেতৃত্বে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং দল ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হয়। সে দলের মুক্তিযোদ্ধারা ছিল আবু আক্কাছ আহমেদ, হাবিব, আনারুল হক প্রমূখ। ত্রিমোহনী ব্রিজটি ভেঙ্গে দেয়ায় নেত্রকোণার সঙ্গে পূর্বধলা ও দূর্গাপুরের সড়ক যোগাযোগ সাময়িক বন্ধ হয়ে পড়েছিল।
১ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়পুর বিরিশিরি রাস্তায় মাইন পুঁতে ২ জন পাক সৈন্যকে হত্যা করে। ৭ অক্টোবর আটপাড়া থানা সদর থেকে কয়েকজন পাকসেনা তাদের সহযোগী রাজাকারদের নিয়ে গ্রামের দিকে যাত্রা করে। আটপাড়া সদর থেকে প্রায় ৪ মাইল পূর্ব দিকে সকাল ১০ টায় রাজাখালী ফেরী পারাপারের সময় পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পড়ে। সে আক্রমণে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। প্রবল আক্রমণে পাকহানাদাররা আর অগ্রসর না হয়ে পেছন ফিরে চলে যায়।
৯ অক্টোবর মোহনগঞ্জ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এ্যামবুশে পড়ে ৪ পাকিস্তানী রেঞ্জার নিহত হয়। পরদিন ১০ অক্টোবর রাত ১২ টার দিকে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মোহনগঞ্জ থানার উপর প্রচন্ড বেগে আক্রমণ করে। বেশিরভাগ শত্রু সৈন্যই ঘুম থেকে জেগে অপ্রস্তুত অবস্থায় দৌড়াদৌড়ি করছিল। ট্রেঞ্চে অবস্থানরত কয়েকজন মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ১ ঘন্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে শত্রু সেনারা থানার অবস্থান ত্যাগ করে রাতে অন্ধকারে বারহাট্টায় পালিয়ে যায়। ভোর রাতেই মোহনগঞ্জ থানা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়। পরদিন ধর্মপাশা থেকে জলপথে চলাচলরত পাকসেনাদের ১টি স্পীডবোট পানিতে তলিয়ে দেয়া হয়েছিল।
১৪ অক্টোবর দূর্গাপুর-নাজিরপুর সড়কে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে ২ জন পাক সেনা নিহত হয়। ১৭ অক্টোবর নেত্রকোণা সদর থানার বাঘরা রেল সেতুটি মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। একই দিন পাকসেনাদের একটি গ্রুপ মদন থেকে কেন্দুয়া যেতে চায়। পথিমধ্যে আখশ্রী নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পড়ে। সে আক্রমণে হতাহতের সঠিক তথ্য উদ্ধার আজো সম্ভব হয়নি। ২১ অক্টোবর দূর্গাপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদে পড়ে ৯ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। এদের বাঘমারা ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয়। ২৯ অক্টোবর নেত্রকোণা সদরের ঠাকুরাকোণায় টহলরত শত্রুসেনাদের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের হঠাৎ আক্রমণে ২ জন নিয়মিত ও ৪ জন অনিয়মিত পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়।
অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহ-জারিয়া রেলপথের কুকুয়াখালী ব্রিজ ও একিয়ারকান্দা ব্রিজে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে চলে যায়। এতে পাক সেনারা ভীত হয়ে অবিরাম গুলি ছুঁড়েছিল। এ সকল স্থানগুলোতে দু/চার রাউন্ড গুলি ছুড়ার উদ্দেশ্য ছিল পাকসেনাদের গুলি অপচয় করানো।
১ নভেম্বর বিরিশিরি-বিজয়পুর রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধাদের পেতে রাখা এ-পি মাইন বিষ্ফোরণে ১ জন পাকসেনা নিহত হয়। একই দিন কাজী ফোর্সের ২৬ জন গেরিলাযোদ্ধা ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোর ৪টা থেকে মদনে অবস্থানরত পাক সৈন্যদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়। ১৭২ ঘন্টা স্থায়ী ছিল এ যুদ্ধ। বিরতিহীন এ যুদ্ধই নেত্রকোণার রণাঙ্গণের সর্বদীর্ঘ যুদ্ধ। অন্যদিকে মদনের অবরুদ্ধ ও আক্রান্ত বাহিনীকে উদ্ধারের জন্য নেত্রকোণা থেকে পাকবাহিনীর একটি দল প্রেরিত হয়েছিল। ৫ শতাধিক পাক সৈন্যের দলটি ৭ নভেম্বর কেন্দুয়া ভায়া মদন আসার পথে কাইটাল নামক স্থানে নজরুল কোম্পানি ও মাহবুব কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পড়ে। সে সময় কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। এরপরও পাক সেনাদের সে দলটি যুদ্ধ করতে করতে অগ্রসর হয়ে মদনের জাহাঙ্গীরপুরের খেলার মাঠে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে মদন সদরে আটকে পড়া সহযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে গুলি চালায়। পরদিন ৮ নভেম্বর সকাল ৭ টায় মদনে অবরুদ্ধ পাকসেনারা মদন ত্যাগ করে নেত্রকোণায় চলে আসে। যুদ্ধশেষে মদনে প্রথম স্বাধীন ও মুক্তাঞ্চলের সূচনা করেছিল।
২ নভেম্বর নেত্রকোণার ঠাকুরাকোণায় মুক্তিযোদ্ধাদের হঠাৎ আক্রমণে পাকবাহিনীর একটি রসদবাহী নৌকা আটকা পড়ে। সে নৌকায় পাকবাহিনীর ৭শ মন চাল মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়েছিল। সে মাসের প্রথম সপ্তাহেই পূর্বধলায় কুমারখালী ব্রিজে পাকসেনাদের উত্যক্ত করার লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধারা কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল এবং ব্রিজের পাশের বাড়ির দু’জন পাকসেনাদের তোষামোদকারীকে হত্যা করে পুকুর পাড়ে ফেলে যায়। এরা ছিল সহোদর।
১৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দ্বীপক সাংমার দল ময়মনসিংহ জারিয়া রেলপথে পূর্বধলার পাবই ব্রিজে পাক হানাদারদের উপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের গোয়েন্দা সূত্রে খবর ছিল ওই ব্রিজে অবস্থানরত রাজাকার লাল মিয়ার নেতৃত্বে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করবে। নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও রাজাকার লাল মিয়া যখন আত্মসমর্পণ করেনি তখনি মুক্তিযোদ্ধারা পাবই ব্রিজে বাংকারের উপর আক্রমণ শুরু করে। পরদিন পাকসেনারা পাবই গ্রামে বেশ ক’টি বাড়ি আগুন দিয়ে ভষ্ম করে দেয়।
১৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি কোম্পানী একত্র হয়ে পূর্বধলা থানা সদর আক্রমণ করে। সে আক্রমণে পূর্বধলা রেল ব্রিজের বাংকারে অবস্থানরত ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়েছিল। ২০ নভেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা কেন্দুয়ার বসুর বাজারে একটি রাজাকার ক্যাম্পের উপর আক্রমণ করে। অতর্কিতে এ আক্রমণে রাজাকাররা প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ করলেও পরে বেশি সময় টিকে থাকতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্পটি দখল করে নেয়। রাজাকারদের অনেকে পালিয়ে যায়, বাকীদের মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে। এ আক্রমণে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছিলেন। পরে তিনি শহীন হন।
২৩ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা দূর্গাপুর আক্রমণ করেছিলেন। সে আক্রমণে ২ জন শত্রু সৈন্য নিহত ও ১ জন আহত হয়েছিল। ২৪ নভেম্বর বিরিশিরি-বিজয়পুর সড়কে চলাচলকারী পাকবাহিনীর একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁদে পড়ে আক্রান্ত হয়। সে সময় ৫ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছিল। একই দিনে বিজয়পুর ও বারোমারী পার্ক আর্মিদের অবস্থানের উপর মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর গোলাবর্ষণ করে। ২৫ নভেম্বর মোহনগঞ্জ থানায় অবস্থানরত পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়।
২৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল আটপাড়া থানার দুওজ গ্রামে অবস্থান নেয়। বেলা ১১ টার সময় পাকিস্তানী একটি রেঞ্জার্স গ্রুপ ও কয়েকজন রাজাকার দুওজ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পড়ে। উভয়পক্ষে প্রচন্ড গোলাগুলির পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছিলেন। এই যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেছিলেন। ২৮ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা বারহাট্টা থানা আক্রমণ করে ১০ জন অনিয়মিত পাকসেনাকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই নেত্রকোণা মহুকুমার বিভিন্ন স্থানে খন্ড খন্ড যুদ্ধ একনাগাড়ে চলছিল। ১ ডিসেম্বর মোহনগঞ্জ থানার বড়তলী গ্রামে পাক আর্মিদের উপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেছিলেন। সে আক্রমণে ৩৫ জন পাকসেনা নিহত হয়েছিল। পরদিন ২ ডিসেম্বর পাকবাহিনী বড়তলী গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে অনেক ঘরবাড়ী ভষ্ম করে দিয়েছিল। ৩ ডিসেম্বর ঝাঞ্জাইল বিরিশিরি রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর একটি ট্রাকের উপর আক্রমণ করেছিলেন। সে সময় ৬ জন পাকসেনা নিহত হয়েছিল। চোরাগুপ্তা সে আক্রমণের সময় স্থানীয় জনৈক কৃষক আহত হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
৩ ডিসেম্বর দূর্গাপুরের বিজয়পুরে পাকসেনাদের ক্যাম্পের উপর মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে আক্রমণ করেন। সে আক্রমণ একনাগাড়ে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী বিজয়পুর থেকে পালিয়ে দূর্গাপুরে চলে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়পুর ক্যাম্প দখল করে নেন। একে একে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বাংকারগুলো চার্জ করতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর পোঁতা একটি মাইন বিষ্ফোরণ ঘটে। এতে নেত্রকোণার ওসমান গণি তালুকদার গুরুতর আহত হন। তিনি এখনো একটি পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব জীবন যাপন করছেন। ৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনীরা দূর্গাপুর থেকে পালিয়ে যায়। স্বাধীন হয় দূর্গাপুর। ৮ ডিসেম্বর একে একে নেত্রকোণার প্রত্যেক থানাই মুক্ত হয়ে পড়ে। পাকবাহিনীরা অনেক থানা থেকে সরে এসে নেত্রকোণা শহরে আশ্রয় নেয়। নেত্রকোণাকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা মরিয়া হয়ে ওঠেন। ৮ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী ক্যাপ্টেন চৌহানের পরামর্শে মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিক আহমদের নেতৃত্বে নেত্রকোণা শহর আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা দু’ভাবে বিভক্ত হয়েছিলেন। শহরের উত্তর দিক থেকে মিত্রবাহিনী আক্রমণ চালাবে। এতে পাকবাহিনী শহর থেকে দক্ষিণ দিক দিয়ে বেরিয়া ময়মনসিংহের রাস্তা ধরবে। সে সময় দক্ষিণ দিকে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ করবে। দক্ষিণ দিকে অবস্থানরত শ’তিনেক মুক্তিযোদ্ধা ওঁৎপেতে রয়েছে রাত থেকেই নেত্রকোণার কৃষি ফার্মে। রাত গড়িয়ে প্রায় ভোর, উত্তর দিকের আক্রমণের অপেক্ষায় দক্ষিণের মুক্তিযোদ্ধারা। এক পর্যায়ে আক্রমণ হলো পাক আর্মি পালানোর চেষ্টায় শহরের দক্ষিণ দিকে সরে এলো। শুরু হলো যুদ্ধ। বলতে গেলে সম্মুখ যুদ্ধ। সে যুদ্ধ হলো ৫/৬ ঘন্টা। মুক্তিযোদ্ধারা সে সময় প্রবলভাবে উত্তেজিত হয়ে যুদ্ধ করে চলেছেন। প্রবল উত্তেজনায় মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় যুদ্ধের কৌশল ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। অনেকে শত্রু নিধনে দৌড়ে এগোতে থাকেন। এ অবস্থায় সে যুদ্ধে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা আবু খাঁ, আব্দুস সাত্তার ও আব্দুর রশিদ। আহত হয়েছিলেন নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিক আহমেদ। আরো বেশি লোকক্ষয়ের আশঙ্কায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু সরলে পাকবাহিনীরা ময়মনসিংহের রাস্তা ধরে পালিয়ে যায়। ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোণা মুক্ত হয়।
৮ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে পাকবাহিনী পূর্বধলা থেকে পালিয়ে যায়। ৯ ডিসেম্বর বেলা ১১ টায় গৌরীপুর থেকে ট্রেনযোগে পূর্বধলা সদরে প্রবেশের চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল প্রতিরোধে ট্রেনটি পূর্বধলা বাজার সংলগ্ন রেলব্রিজ অতিক্রম করতে পারেনি। ক্রমে ট্রেনটি পেছনে ফিরে যায়। যাবার পথে পাকবাহিনীরা পাবই ব্রিজটি ভেঙ্গে দিয়ে যায়। পূর্বধলার ওই যুদ্ধই নেত্রকোণার একাত্তরের রণাঙ্গণের শেষ যুদ্ধ। ৯ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত নেত্রকোণার বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া আক-আর্মিরা সড়ক পথে ফিরে যাচ্ছিল। চট্টগ্রামের পটিয়ার মুক্তিযোদ্ধা সুধীর বড়ুয়া সন্ধ্যায় পালিয়ে যাওয়া পাক আর্মিদের একটি গাড়িকে সহযোদ্ধা মনে করে হাত মিলাতে চান। সে সুযোগে পাকসেনারা তাকে গুলি করে। সুধীর বড়ুয়া ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। শহীদ সুধীর বড়ুয়াকে শ্যামগঞ্জ রেলওয়ে মাঠের উত্তর পাশে সমাহিত করা হয়েছে। নেত্রকোণার রণাঙ্গনের অনেক যুদ্ধের সঠিক তথ্য সংগ্রহ এখনো সম্ভাব হয়নি। অনেক বীরমুক্তিযোদ্ধা তাঁর বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর খন্ড খন্ড স্মৃতি হাতড়াতে পারেন। কিন্তু সঠিক তারিখ, যুদ্ধের কৌশল, সহযোদ্ধার নাম পর্যন্ত ভুলে গেছেন। ফলে অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধগুলো কালো অক্ষরে ধরে রাখার চেষ্টা করেও সম্ভাব হয়নি। নেত্রকোণার রণাঙ্গনগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় তৎকালীন নেত্রকোণা মহুকুমার ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন নেত্রকোণার মুক্তিযোদ্ধারা শুধু নেত্রকোণায় যুদ্ধ করে শহীদ হননি। দেশের বিভিন্ন জেলার রণাঙ্গনগুলোতে নেত্রকোণার মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধ করেছেন এবং অনেকে শহীদ হয়েছেন।
নেত্রকোণার বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়। পাকসেনাদের পরাজয়ের গ্লানিই বেশি। ভৌগলিকভাবে বিশ্লেষণে অনুমিত হয় দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে নেত্রকোণার অনেক ভিন্নতা রয়েছে। জেলার একদিকে পাহাড় অপর দিকে জলাভূমি হাওরাঞ্চল। মধ্যবর্তী অঞ্চল রাস্তাঘাট বিহীন দুর্গম। যা পাকহানাদারদের জন্য ছিল প্রধান অন্তরায়। ইচ্ছে করলেই পাক হানাদারদের পক্ষে হাওর কিংবা পাহাড়িয়া অঞ্চলে প্রবেশ করা সম্ভব ছিল না। অনেক প্রস্তুতির পরেই তাদের যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করতে হয়েছে। রাস্তাঘাট জানতে হয়েছে। অপরদিকে নেত্রকোণার মুক্তিযোদ্ধারা এ অঞ্চলের ভৌগলিক পরিবেশের সঙ্গে জন্মগতভাবেই পরিচিত। স্থানীয় পথঘাট তাদের নিত্যদিনের জানা। পাহাড়, জলমগ্ন হাওর তাদের জীবন যাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে সে অঞ্চলে আত্মগোপন করে গেরিলা কৌশলে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল সহজ।
সে কারনেই মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধক্ষেত্রে কৃতিত্ব ছিল অনেক বেশি। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোণার প্রায় তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এরা নেত্রকোণাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রণাঙ্গনে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। সে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের ইতিহাস অনেকেরই অজানা।
নেত্রকোণার অসংখ্য ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জনা বাড়ি ত্যাগ করেছেন। যুদ্ধ শেষে অনেকের আর বাড়ি ফেরা হয়নি। কোথায় প্রশিক্ষণ নিয়ে কোন্ যুদ্ধে অংশ নিয়ে জীবন দিয়েছেন তার খবর আজো আমাদের অজানা। অনেকে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে প্রবেশের পূর্বেই পাকবাহিনী কিংবা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আমরা তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত/মুক্তি কামনা করছি।
খেতাব প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের নামঃ
| |
| |
| |
| |
| |
| |
|
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস