Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

জেলার পটভূমি

নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যঃ

ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস প্রাচীন ঐতিহ্যে টই-টুম্বুর ও  ঐতিহ্যের বিচিত্র ঘটনা সম্ভারে গর্বিত। বিভিন্ন তাত্ত্বিক পর্যালোচনায় স্পষ্টতঃ প্রমাণ করে যে সাগর বা সমুদ্রগর্ভ থেকে জেগে ওঠায় এ অঞ্চলটি মানব বসবাসের যোগ্য ভূমিতে পরিণত হয়েছিল। গারো পাহাড়ের পাদদেশ লেহন করে এঁকেবেঁকে কংস, সোমেশ্বরী, গণেশ্বরী, মহেশ্বরী, গোরাউৎরা নদীসহ অন্যান্য শাখা নদী নিয়ে বর্তমান নেত্রকোণা জেলার জলধারার উদ্ভব। এ জেলার প্রত্যেক নদীই জেলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত। ফলে সমগ্র জেলার ভূমি উত্তরাংশে উঁচু এবং ক্রমে দক্ষিণ-পূর্বাংশে ঢালু।

খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এ অঞ্চল গুপ্ত সম্রাটগণের অধীন ছিল। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, গুপ্তযুগে সমুদ্রগুপ্তের অধীনস্থ এ অঞ্চলসহ পশ্চিম ময়মনসিংহ কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুরাজ শশাংকের আমন্ত্রণে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ এন সাঙ যখন কামরূপ অঞ্চলে আসেন, তখন পর্যন্ত নারায়ণ বংশীয় ব্রাহ্মণ কুমার ভাস্কর বর্মণ কর্তৃক কামরূপ রাজ্য পরিচালিত ছিল। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে পূর্ব ময়মনসিংহের উত্তরাংশে পাহার মুল্লুকে বৈশ্যগারো ও দুর্গাগারো তাদের মনগড়া রাজত্ব পরিচালনা করতো। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে জনৈক মুসলিম শাসক পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চল আক্রমণ করে অল্প কিছুদিনের জন্য মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। অতঃপর চতুর্দশ শতাব্দীতে জিতারা নামক জনৈক সন্ন্যাসী কর্তৃক কামরূপের তৎকালীন রাজধানী ভাটী অঞ্চল আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়। সে সময় পর্যন্তও মুসলিম শাসক ও অধিবাসী স্থায়ীভাবে অত্রাঞ্চলে অবস্থান ও শাসন করতে পারেনি। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে (১৪৯৩-১৫১৯) সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল মুসলিম রাজত্বের অন্তর্ভূক্ত হয়।

আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’র পুত্র নসরৎ শাহ’র শাসনামলে (১৫১৯-১৫৩২) দু'একবার বিদ্রোহ সংঘটিত হলেও বিদ্রোহীরা সফল হয়নি। সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চলেই নসরৎ শাহ’র শাসন বলবৎ ছিল। নসরৎ শাহ’র পদচিহ্ন লোপ পেলেও তার অনেক স্মৃতিচিহ্ন কালের সাক্ষী হয়ে আছে। নসরৎ শাহ-র উত্তরাধিকারীরা (১৫৩৩-১৮৩৮) কিংবা তার পরবর্তী লক্ষ্মণাবতীর অন্য শাসকেরা ময়মনসিংহ অঞ্চলের উপর আধিপত্য বজায় রাখতে পারেনি। ময়মনসিংহের উত্তরাংশ কোচদের পুনরাধীন হয়ে পড়ে। বাকী অংশ দিল্লীর পাঠান সুলতান শেরশাহ-র (১৫৩৯-১৫৪৫) শাসনভুক্ত হয়েছিল। তৎপুত্র সেলিম শাহ’র শাসনের সময়টি (১৫৪৫-১৫৫৩) ছিল বিদ্রোহ ও অস্থিরতায় পূর্ণ। রাজধানী দিল্লী থেকে অনেক দূরে ও কেন্দ্রীয় রাজশক্তির দূর্বলতার সুযোগে প্রধান রাজস্ব সচিব দেওয়ান সুলায়মান খাঁ (যিনি পূর্বে কালিদাস গজদানী নামে পরিচিত ছিলেন) সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করেন। এতে করে দেশী ও বিদেশী রাজ্যলিপ্সুরা এতদঞ্চল দখলের প্রয়াস পায়। এর মধ্যে ভাটী অঞ্চল (পূর্ব-উত্তরাংশ) সোলায়মান খাঁ-র দখলভুক্ত ছিল। কেন্দ্রীয় শাসকের প্রেরিত সৈন্যদের হাতে সোলায়মান খাঁ নিহত হলেও তার দু’পুত্রের মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশা খাঁ খিজিরপুর থেকে ভাটী অঞ্চলে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ঈশা খাঁ’র মৃত্যুর পর তৎপুত্র মুসা খাঁ ও আফগান সেনা খাজা উসমান খাঁ কর্তৃক অত্রাঞ্চল শাসিত ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭) সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল মোঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়।

মোগল সেনাদের যুদ্ধ কৌশল জনিত কারণে অনেক দূর্গ প্রতিষ্ঠা হয়। এছাড়া পূর্ববর্তী শাসকদের তৈরী ভগ্নদুর্গও তারা সংস্কার সাধন করে ব্যবহার করেছিল। ওই সকল ঐতিহাসিক যুদ্ধদূর্গের ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোয়াই বাড়ি দূর্গ যা পরবর্তীকালে ঈশা খাঁ’র পারিষদ মসজিদ জালাল এর আবাস বাটী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নেত্রকোণা সদরের অদূরে পুকুরিয়ার ধ্বংস প্রাপ্ত দূর্গসহ অনেক নিদর্শন মাটি চাপায় হারিয়ে গেছে। এরপরও কিছু নিদর্শন এখানকার ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। পাশাপাশি সে সময়কার শাসকদের অনেক জনহিতকর কাজের সন্ধান পাওয়া যায়। তন্মধ্যে উল্লেখ্য খোঁজার দিঘী নামে পরিচিত জলাশয়গুলো। অনেকে মনে করেন খাজাদের জায়গীর ভূমিতে জনহিতকর কাজের অন্যতম পানীয় জল ব্যবস্থায় খাঁ দিঘীগুলো খনন করেছিলেন। তাই খোয়াজ খাঁ’র দিঘী থেকে খোজার দিঘী। এর ভিন্ন মতামতও রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন খাজা উসমান খাঁ’র দিঘী থেকে খাজার দিঘী, সে থেকে খোজার দিঘী নামে পরিচিতি পায়। তৎকালীন সুসঙ্গ, নাসিরূজিয়াল, মৈমনসিংহ, সিংধা ও খালিয়াজুরী পরগণার ভূমি নিয়ে বর্তমান নেত্রকোণা জেলার অবস্থান।

ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৮০ খিস্টাব্দে নেত্রকোণা মহকুমা মঞ্জুর করে (কারণসমূহ নেত্রকোণা সদর অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে)। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ৩ জানুয়ারি থেকে নেত্রকোণা মহকুমার কার্য শুরু হয়। ব্রিটিশ আমলে এ জেলায় কৃষক বিদ্রোহ, পাগলপন্থী বিদ্রোহ, টংক আন্দোলন ও তেভাগা আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯৪৫ সালে জেলা সদরের নাগড়ায় তিনদিনব্যাপী সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

পাকিস্তান আমলে নেত্রকোণা মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করার জন্য গণদাবী ওঠে। সে দাবী পূরণের লক্ষ্যে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সরকার কেন্দুয়ায় জেলা সদর স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করেছিল। কিন্তু সরকারের সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি নেত্রকোণা মহকুমাকে জেলা ঘোষণা করা হয়। (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন নম্বর-এস-আর, ও ১৭-এল/৮৪/এম,ই,আর(জ,এ-২)/২৬৪/৮৩-৩০)। একই খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নব প্রতিষ্ঠিত জেলার কার্যক্রম শুরু হয়।

নেত্রকোণার স্বাধীনচেতা জনগোষ্ঠী ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের সারাংশ শুনেই অনুধাবন করতে পেরেছিল তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে যেতে হবে। তাই মুক্তিযুদ্ধের জন্য নেত্রকোণাবাসীর প্রস্তুতি গ্রহণে বেশি সময় ব্যয় হয়নি। ৭ মার্চ এর পর থেকেই নেত্রকোণার প্রত্যেক থানা শহরগুলোতে যুদ্ধে যাবার জন্য যুব সমাজ উদগ্রীব হয়ে ওঠে। প্রতিদিন থানা পর্যায়ে গ্রামগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ সশস্ত্র মিছিল করে আসতে থাকে। নেত্রকোণা শহরসহ থানা শহরগুলোর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান মানুষগুলোও নীতি নির্ধারণের কাজ শুরু করে দেন। নেত্রকোণার রণাঙ্গনগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় তৎকালীন নেত্রকোণা মহকুমার ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেছেন। নেত্রকোণা মহকুমার মুক্তিযোদ্ধাগণ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানের অনেক মুক্তিযোদ্ধা নেত্রকোণার বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন এবং অনেকে শহীদ হয়েছেন। তেমনি দেশের বিভিন্ন জেলার রণাঙ্গনগুলোতে নেত্রকোণা মুক্তিযোদ্ধারাও যুদ্ধ করেছেন এবং অনেকে শহীদ হয়েছেন। [সূত্র: আলী আহাম্মদ খান আইয়োব এর ‘ নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস’ ও বাংলাপিডিয়া (পৃষ্ঠা-১৬৮, খন্ড-৫)]