বিপন্ন এক জনপদঃ
“মাটির ওপর জলের বসতি, জলে ওপর ঢেউ
ঢেউয়ের সাথে পবনের পিরিতি, নগরে জানে না কেউ”
হাওর। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অফুরন্ত সম্ভাবনাময়, অথচ বিপন্ন এক জনপদ। বর্ষায় এ জনপদকে মনে হয় কূলহীন সাগরের মতো। এ সময় হাওরের বুক জুড়ে থাকে জল আর জল। অন্যদিকে শীতকালে হাওর হয়ে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর, যেখানে দোল খায় সবুজ-সোনালী ধানের শীষ। তখন হাওরের দিকে একটু তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়। সহজ করে বলা যায়, বাংরাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পিরিচ আকৃতির বৃহৎ ভূ-গাঠনিক অবনমনটির নামই হাওর।
বিভিন্ন ইতিহাস ও প্রাচীন পান্ডুলিপি থেকে জানা যায়, বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি বড় অংশ এক সময় কালীদহ সাগর’ (মতান্তরে লৌহিত্য সাগর) নামে একটি বিশাল জলরাশিতে নিমজ্জিত ছিল। পরবর্তীতে ভূ-প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে তা পিরিচ আকৃতির নিন্ম সমতল ভুমিতে পরিণত হয়- যা পরিচিত হয় হাওর নামে। অবশ্য, ‘হাওর’ নাম নিয়েও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছ। এ অঞ্চলের লোকেরা ‘স’ কে ‘হ’ বলে উচ্চারণ করে। তেমনি ‘সাগর’কে বলে ‘হাগর’। এভাবেই ‘সাগর’ শব্দের বিকৃত রুপ হিসাবে ‘হাগর’ এবং ‘হাগর’ থেকে ‘হাওর’ শব্দের উৎপত্তি হয়। উল্লেখ, ভাটি অঞ্চল নামে ও হাওরাঞ্চলের আরেকটি পরিচিতি রয়েছে। প্রসঙ্গত, দেশের সাতটি উপজেলা নিয়ে বিশাল হাওর এলাকা গঠিত। জেলা গুলো হচ্ছেঃ নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভী বাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মনবাড়িয়ার একাংশ।
মানব বসতির সূচনাঃ
কবে কোন অমানিশার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে প্রথম আলোর মুখ দেখেছিল এই হাওরাঞ্চল? এর উত্তর নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, লৌহিত্য সাগর থেকে নিম্ন সমভুমিতে (প্লাবন সমভূমি) পরিণত হওয়ার পরও বহু বছর বিরান পড়ে ছিল হাওর এলাকা। এরপর পলিমাটি বিধৌত এ উর্বর ভূমিতে প্রথম বসতি স্থাপন করে অস্ট্রো-মঙ্গোলিয়ান জাতি গোষ্ঠীর কোচ, হাজং, গারো ও খাসিয়া উপজাতিরা। এর মধ্যে কোচরাই ছিল সংখ্যাধিক্য। তারাই এসে প্রথম সেখানে অনেক উচু করে বাস্ত্তভিটা নির্মাণ করে এবং শুরু করে জমির চাষাবাদ এবং মাছ ধরার পেশা। এরপর এক সময় অঞ্চলটি কামরুপ রাজ্যের অধীনে চলে যায়। ততদিনে বিভিন্ন স্থানে প্রচার হয়ে যায় এ উর্বর ভূমির খবর। তাই সে ভূ সম্পত্তির মালিকানা পেতে উপজাতিদের পাশাপাশি অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনও ছুটে আসে সেখানে। আর এভাবেই হাওর জনপদে গড়ে ওঠেছিল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর এক মিশ্র মেলবন্ধন। যাদের উত্তরসূরীদের নিয়ে হাওর অঞ্চল এখনও মাথা নুয়ে শুয়ে আছে হিজল-করচের ছায়ায়।
বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাওঃ
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। কিন্তু হাওরে ঋতু মাত্র দু’টি। একটি বর্ষা। অন্যটি হেমন্ত। বছরের প্রায় পাঁচ-ছ’মাস এখানে বর্ষা থাকে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে শুরু হয়ে বর্ষা শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। এ সময় হাওর সাগরের রুপ ফিরে পায়। পানিতে একাকার হয়ে যায় সব মাঠ-ঘাট। জলবন্দি হয়ে পড়ে প্রতিটি গ্রাম, এমনকি প্রতিটি বাড়িও। তখন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামেতো বটেই, এক বাড়ী থেকে আরেক বাড়িতে যেতেও নৌকা লাগে। যাতায়াত ব্যবস্থাটিও হয়ে ওঠে সহজ সাধ্য। কিন্তু বর্ষা বিদায় নিয়ে হেমন্ত এলেই ঘটে বিপত্তি। কারণ হাওরের অনেক এলাকায় তেমন রাস্তাঘাট নেই। এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে হয় পায়ে হেঁটে। অর্থাৎ দুই পা-ই তখন একমাত্র ভরসা। আর ফসলি জমির ফাঁক-ফোকর দিয়েই চলে গেছে হেঁটে চলার অনেক মেঠো পথ। দূর-দূরান্তের এসব পথ পাড়ি দিতে হয় সঙ্গে চিড়া-মুড়ী নিয়ে। সম্ভবতঃ এসব কারণেই হাওরের যোগাগোগ ব্যবস্থাকে ছড়া কেটে বলা হয় ‘বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও’। তেমনি আরেকটি ছড়া- ‘যেখানে চলে না রিক্সা গাড়ি-তার নাম খালিয়াজুরি’। এটি হাওর উপজেলা খালিয়াজুরির যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর রচিত একটি লোকজ ছড়া। এ ছাড়া শুনে বুঝতে বাকি থাকে না যে, হাওরদ্বীপ খালিয়াজুরীতে এই একবিংশ শতাব্দীতেও গাড়ি তো দূরের কথা, কোন রিক্সাও চলে না। অর্থাৎ ‘পথিক’ শব্দটিকে যথার্থই সার্থক করে তুলেছেন হাওর বাসিন্দারা।
হাওরের জলাতংকঃ
হাওরের লোকজন প্রতিবছর ‘জল আতঙ্কে’ ভোগে। বর্ষায় গোটা হাওর এলাকা জলে ফুলে ফেঁপে ওঠে। তখন হাওর আর হাওর থাকে না। পরিণত হয় কূলহীন সমুদ্রে। আর গ্রামগুলো হয়ে ওঠে একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। কুচুরিপানার মতো ভাসতে থাকে দ্বীপ সদৃশ গ্রামগুলো। এ সময় হাওরের প্রকৃতিও হয়ে ওঠে ভয়াবহ, উন্মাতাল। কোন বাধাই মানতে চায়না সে। সামান্য বাতাসেই হাওরের পানিতে প্রচন্ড ঢেউ ওঠে। বিশাল বড় বড় এসব ঢেউ আঘাত করে গ্রামগুলোর ওপর। এতে ভাঙ্গে গ্রাম, বসতবাড়ি। আঞ্চলিক ভাষায় এ ধরনের দুর্যোগকে বলা হয় ‘আফাল’। গত এক শতাব্দীতে |
Site was last updated:
2024-11-21 11:30:04
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS |